হুইসেল বাজিয়ে আবার ছুটবে ‘লাতুর ট্রেন’
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ নভেম্বর ২০১৭
দেলোয়ার হোসাইন, সিলেট থেকে:
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ফের চালু হচ্ছে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথের সেই ‘লাতুর ট্রেন’। গত ১৫ নভেম্বর বুধবার রাজধানীর রেলভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ভারতের কালিন্দী রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের (টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিডেটের একটি বিভাগ) সঙ্গে এই চুক্তি হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) আব্দুল হাই ও ভারতের কালিন্দী রেল নির্মাণের ভাইস প্রেসিডেন্ট শারদ শর্মা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে অনেক রেল প্রকল্প ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে , অনেক প্রকল্প চলমান আছে। এগুলো শেষ হলে জনগণ রেলের মাধ্যমে আরও উন্নত সেবা পাবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন জানান, চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ৫৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কালিন্দী রেল আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫২.৫৪ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ কাজ শেষ শেষ করবে। এছাড়া শাহবাজপুর, মুড়াউল, বড়লেখা, কাঁঠালতলী, দক্ষিণভাগ ও জুড়ীর ছয়টি স্টেশন ও ছোট-বড় ৫৯টি সেতু নির্মাণ করা হবে।
১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর চালু হওয়া লাতুর ট্রেনের ঝিক্ ঝিক্ শব্দে মুখর ছিলো কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথের চার উপজেলা। রেলপথ ও ট্রেনকে ঘিরে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া ও সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত ছিল। কিন্তু ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা, কাঠের স্লিপার, সেতুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ সংস্কারের অভাব, লোকসান এবং স্টেশন ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে ২০০২ সালের ৭ জুলাই বিএনপি সরকারের সময় লাতুর ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে নষ্ট হয় রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ, দখল হয় বহু সরকারি ভূ-সম্পত্তি। রেলের সম্পদ রক্ষা এবং আবার ট্রেন চালুর দাবিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন।
ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বার বার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর আবার ভেস্তে যায়। ২০০৮ সালে মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ মো. শাহাব উদ্দিন এমপি কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়লেখা সফরকালে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক জনসভায় সংসদ সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন রেললাইন চালুর দাবি জানালে শেখ হাসিনা রেল লাইন চালুর ঘোষণা দেন।
সে লক্ষ্যে ২০১৫ সালে একনেকের বৈঠকে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিকে পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য একনেকে ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এমন খবরে চার উপজেলার মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ্ব মোঃ শাহাব উদ্দিনকে অভিনন্দন জানান দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই তাদের আনন্দ ফিকে হতে থাকে। একনেকে বিল পাস হওয়ার পরও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি।
প্রায় ১৫ বছর পর কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ চালু করতে ভারতের কালিন্দী রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় এ অঞ্চলের প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের মনে নতুন করে আশার আলো জেগেছে । স্থানীয়রা জানান, দুই জেলার ৪ উপজেলার লাখ লাখ মানুষের প্রাণের দাবি ছিলো কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনটি চালু করার। রেলপথ চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। সেইসাথে বদলে যাবে এ অঞ্চলের চার উপজেলার চেহারা। এবার ঠিক সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
এ বিষয়ে উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন সাপ্তাহিক দেশ’কে বলেন, লাতুর ট্রেন বড়লেখা-জুড়ীবাসী বিশেষ করে আমাদের শাহবাজপুরের ( যার নাম এক সময় ‘লাতু’ ছিল ) ঐতিহ্যের প্রতীক। এক সময় শুধু বড়লেখা নয় বিয়ানীবাজারের বিরাট অংশের জনগণের সিলেট-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের বাহন ছিল এই লাতুর ট্রেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ইংল্যান্ডের লুটন শহরে বিয়ানীবাজারের গবিন্দশ্রী গ্রামের এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়ের পর লাতুর ট্রেনের কথা জিজ্ঞসা করলেন। বললেন, তিনি শাহবাজপুর থেকে ছাতক যাতায়াত করতেন লাতুর ট্রেনে। আজও চোখের সামনে ভেসে উঠে ছেলেবেলার সেই লাতুর ট্রেনের প্রাণ চাঞ্চল্য। তিনি বলেন, লাতুর ট্রেন চালু হবার খবরে আমি আবেগাপ্লুত। শাহবাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে হুইপ শাহাব উদ্দিন সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই এবং এই প্রকল্পের কাজ যেন দ্রুত শেষ হয় এই অনুরোধ করছি।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ মো. শাহাব উদ্দিন সাপ্তাহিক দেশ’কে বলেন, আগামী মাস থেকেই এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, কুলাউড়া-শাহবাজপুর হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথের কাজ হবে।