যে স্মৃতি অমলিন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ অক্টোবর ২০১৭
নুর লোদী:
খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নাম যদি জীবন হয় তাহলে বলা যায় বিলেতে ভালোই আছি। কিন্তু এই ভালো থাকাটা মেনে নিয়েছি, মনে নিতে পারিনি। এদেশের সরকার যুগ যুগ ধরে তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে আসছে। প্রায় দেড় যুগ আগে শূন্য হাতে বাড়ি ছেড়েছি। দু’বেলা দুমুঠো খাবার নিয়ে কিংবা সন্তানের শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হয়নি কখনো। ভাবতে হয়নি ডাক্তারের ফি অথবা ওষুধের পয়সা নিয়ে।
স্মৃতিকাতর মানুষ আমি। জীবনের সোনালী সময়গুলো কাটিয়েছি জন্মস্থান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা বড়বাড়ি গ্রামে। অমলিন কিছু স্মৃতি বারবার ফিরে আসে চোখের সামনে। বিশাল জনসম্পদ আর আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানুষের মনে এত ধর্মভীরুতার দেশটা কেন যেন আজ কাঙ্খিত লক্ষ্যে যেতে পারছে না- এ প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয় মনের গহীনে। কী নেই আমাদের? তারপরও কেন মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় না? কেন সম্পদের সুষম বণ্টনে মানুষের মাঝে ব্যবধান কমেনা। কেন মানুষ দেশ ছাড়ে কাঙ্গাল মুসাফিরের মতো?
স্মৃতির পাতা থেকে কিছু ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ও আমাদের পশ্চাদপদতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কেন আমার দেশের মানুষ অন্যকে বিপদে ফেলে নিজেকে নিয়ে থাকতে চায়? চরম অবক্ষয়ের কালে কেন মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না? শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সবার মাঝে তার নিজের চিন্তার এবং ক্ষমতার পরিধি অনুযায়ী প্রতারণার অপচেষ্টা। মনে পড়ে গ্রামের বাজারে যখন শসা কিংবা কমলা কিনতে যেতাম, তখন দেখতাম এগুলো বিক্রি হতো হালি হিসেবে। ‘ভাগা’ দিয়ে রাখা চারটি কমলার মধ্যে নিচের তিনটি যে কোন সাইজের হোক না কেন উপরেরটা থাকতো সুন্দর ও পুষ্ট। কবি শাহীন রশিদের ভাষায় “স্মৃতির সুতার টানে জীবনের নোঙর আজ নরকের হিমাগারে”। এ প্রজন্মের মানুষ আমার বিবেচনায় আগের মতো আর শিকড় সন্ধানী নয়। প্রতিকূলতার আর প্রতিবন্ধকতার কারণে মানুষ আর আগের মতো দেশমুখি নয় বললেই চলে। বাংলাদেশে বিমান থেকে অবতরণের পরপরই মানুষের দুর্ভোগ শুরু হয়ে যায়। আর তা শেষ হয় বাংলাদেশ থেকে ফিরে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের পর। বিমানবন্দরে অবতরনের পর ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেয়ার পর তার চেহারায় যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাতে মনে হয় পূর্বজন্মে তার সাথে প্রবাসীদের শত্রুতা ছিলো। আর তাই তো, বর্তমানে নতুন প্রজন্মের বৃটিশ-বাঙালিরা এখন হলিডে করতে চলে যায় ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা কিংবা মধ্যেপ্রাচ্যের কোনো দেশে।
কয়েক যুগ আগে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য লন্ডনে আসি। অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ, বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন বর্ণের। কী সুন্দর রাস্তাঘাট, যেখানে নেই কোনো ধুলাবালি, রাস্তায় চলছে হাজার হাজার গাড়ি, নেই কোনো বিকট শব্দ। চোখ বন্ধ করে দিয়ে একবার কল্পনা করি আমার বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা আর এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা কোথায়? যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। ট্রেন স্টেশন, বাস স্টপ, অফিস আদালত যত জায়গায় জনসাধারণের ভিড় সব জায়গাতেই কেমন সুশৃংখলভাবে মানুষ তার জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন। সবকিছু যেন নিজের কাছে এক অদ্ভুত মনে হতো। এসব দেখে নিজের মনে প্রশ্ন জাগতো এদেশের মানুষ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে কোথাও কি জীবনযাত্রার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। না-কি আল্লাহ এদেশের মানুষকে আলাদা করে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন যা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর হয়ে যায়। এখানে কিছুদিন থাকার পর আস্তে আস্তে নিজেকে এই সভ্যতার মানুষের সাথে মিশিয়ে নিতে পেরেছি।
বছর কয়েক পরে যখন নিজের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করলো তখন বুঝতে পারলাম ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে কোথাও কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া সুযোগ নাই, এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এ দেশের রাষ্ট্র করে দিয়েছে। ছেলেমেয়ের যখন দুই বছর হয় তখন থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। যেখানে নেই রাজনৈতিক কোন অস্থিরতা, বিভিন্ন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কি সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করছে এদেশের সকল মানুষ। এই যে গাড়ি, বাড়ি, পরিবার পরিজন সবকিছু থাকার পরেও কেন যেনো মনে হয় কিছুই নেই, নিঃসঙ্গ। জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় এই মাটিতেই কাটিয়ে দিলাম তবুও যেনো এ মাটিকে আপন করে নিতে পারলাম না। কেনো যেন মনে হয় এদেশ আমার নয়, এ মাটি আমার নয়, এদেশের কোনো কিছুই আমার নয়, সবকিছুই পর পর মনে হয়। আমার সবকিছুই মনে হয় সেখানে। ‘যেখানে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
জানিনা কেন শত চেষ্টা করেও ভুলে থাকতে পারিনি। পৃথিবীতে মনে হয় বাংলাদেশীরাই একমাত্র জাতি স্বদেশ প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পারে। এই পরবাসে নানান রঙের, বহু জাতের মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত জীবন চলার পথে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মতো এতো দেশপ্রেম আছে বলে মনে হয় না। কখনো কখনো মনে হয়, লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত আর ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে একটি স্বাধীন ভূখন্ড। তাই বুঝি আমাদের এতো দেশপ্রেম আর ভালোবাসা। দেশের ভালোবাসা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না, পারবো না জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। জীবন জীবিকার সবকিছু থাকার পরেও কেন যেনো এক দৈন্যতা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, যে মাটিকে মুহূর্তের জন্যও মন থেকে ভালোবাসতে পারলাম না, সেই মাটিতেই অপরিচিত মানুষের সাথে অনন্তকালের জন্য পরকালের যাত্রা শুরু হবে। এ যাত্রা তো স্বেচ্ছায় নয়, এটাই তো নিয়তির অমোঘ নিয়ম।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী, ব্যবসায়ী।