রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যদি সাহায্য করি তাহলে সেটা সরকার বিরোধী কাজ হবে কি-না?
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
প্রশ্নঃ
রোহিঙ্গা মুসলমানরা আমাদের ভাই-বোন। তাদেরকে জ্বালিয়ে মেরে ফেলছে। এই অবস্থায় সরকার যদি তাদেরকে সহযোগিতা না করেন, আমরা নাগরিকরা যদি তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করি তাহলে সেটা সরকার বিরোধী কাজ হবে কি-না এবং তা শরিয়তের দৃষ্টি কিভাবে দেখা হবে।
উত্তরঃ
যখন কোথাও কোন কুকুর-বিড়াল-পশু-পাখিও এভাবে নির্যাতনের শিকার হয় সেখানে তাদেরকে উদ্ধার করা মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব। মুসলমান না হয়ে বার্মাতে যদি এভাবে কুকুর নিধন করা হতো তাহলে আজ সারা দুনিয়া বার্মাকে বয়কট করত। এই দুনিয়ার মানুষের বুঝা উচিত যে বার্মার মুসলমানরাও মানুষ। পশু-পাখির চেয়েও তাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশী। মানুষ হিসাবে তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পশুকে নির্যাতন থেকে উদ্ধার করা যদি মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব হয়, তাহলে নির্যাতিত নিরীহ মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব আরো বেশী। যেভাবে শিশু-নারী-পুরুষকে জবাই করে তাদের ঘর-দোরকে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে তা দেখে কোন মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। মানুষকে এভাবে হত্যা করে তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে কোন দেশ সভ্য বলে গণ্য হতে পারে না। মানুষ হিসাবে সকল মানুষ, দেশ ও সরকারের দায়িত্ব হলো এই হত্যাযজ্ঞ এখনই বন্ধ করে প্রত্যেকে নিজ নিজ ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ও পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।
যদি কোন সরকার এই মানবিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, সেটা হবে একটা ঐতিহাসিক ব্যর্থতা ও মারাত্মক ভুল। সরকারের সাথে কোন প্রকার সরাসরি সঙ্ঘাতে না গিয়ে অন্যান্য বেসরকারী সংস্থা ও ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো এই চরম মানবিক দূর্যোগে যার যা আছে তাই নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসা। মানুষের জীবন নিয়ে এভাবে কোন রাজনীতি ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম এ ধরণের গণহত্যাকে সমর্থন করে না। ফলে, কোন মুসলমানও এমন গণহত্যাকে সমর্থন করা তো দূরের কথা, তা দেখে চুপ করেও বসে থাকতে পারেন না।
কিন্তু দূঃখের বিষয় হলো- আজ সারা দুনিয়ায় মুসলমানরা এতো মূল্যহীন হয়ে গিয়েছেন। এটার মূল কারণ হলো মুসলমানদের নিজেদের ইমানী শক্তি দূর্বল হয়ে গিয়েছে। অনেক মুসলমানের কাছে রাজত্ব, পদ, ক্ষমতা ও অর্থই হলো সব কিছু। ফলে তারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দূর্বল হয়ে গিয়েছে। যে কারণে শুধু বার্মা নয়, অনেক মুসলিম দেশের নীরিহ নাগরিকরা বিনা কারণে রক্ত দিচ্ছেন এই কারণে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন।
প্রশ্নঃ
আমরা অনেক সময় দেখি একেকজনের সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক থাকে। অথচ ইসলামে সব জায়গায় সাম্যতার কথা বলা হয়েছে। তার মানে ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রেও সাম্যতা বজায় রাখা দরকার। এখন আমরা যদি একই সমাজে এইভাবে শুধু কিছু লোকের সাথে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখি এবং অন্যদেরকে গুরুত্ব না দেই তাহলে সেটা কতটুকু ঠিক হবে?
উত্তরঃ
আপনি একটা দারুণ বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ভাই। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বা অন্য মুসলমানকে আপন ভাইয়ের মত মনে করা ও সেই রকম ব্যবহার করাটা ফরজ। তবে, যোগ্যতার কারণে বা সুন্দর বুঝাপড়ার কারণে একেকজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা কম বেশী হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে যদি তিনি একান্ত বন্ধু হিসাবে নিতেন তাহলে তিনি আবু বকরকেই নিতেন। রাসূলুল্লাহ (স) সকল সাহাবাদেরকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু এর ভেতর কিছু সাহাবাকে বেশী কাছে টেনে নিয়েছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু আসল কথা হলো এই সাহাবারা নিজেদের সব কিছু ত্যাগ করেই রাসূলুল্লাহ (স) এর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যার যত বড় ত্যাগ, সে তত বেশী নৈকট্য পায় ও বেশী ভালোবাসা পায়। যদি ত্যাগ ও কর্মের কারণে কেউ একটু বেশী ভালোবাসা অর্জন করে সেটাকে অনৈসলামিক বা ভ্রাতৃত্বের সমতার অভাব হয়েছে বলে মনে করা যাবে না।
আমি দেখেছি, একই দলের লোকেরা নিজ দলের অন্যের ওপর জুলুম করে। এটা যেমন হারাম, তেমনি যিনি যুলুম করেছেন তিনিও তো পরম বন্ধুত্বের দাবী করতে পারেন না।
তবে, আমি কাউকে পছন্দ না করলেও তাকে যেন অবহেলা না করি, তাকে দেখলে তার সাথে যেন খারাপ ব্যবহার না করি, তাকে নিয়ে যেন গীবত না করি, তার যেন ক্ষতি না করি। এটাই হলো ভ্রাতৃত্ব।
আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি- আমার আশে পাশে কিছু ভাই আছেন যারা আমার প্রতি ভালো ব্যবহার করেননি, আমার ওপর জুলুমও করেছেন। কিন্তু যখনই তাদের সাথে আমার দেখা হয় আমি তাদেরকে দেখলে হাসি মুখে সালাম দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি। আমি হজে গিয়ে তাদের জন্যে নাম ধরে ধরে তাদের রহমত ও বরকতের জন্যে দোয়া করেছি। তারা আমার ওপর জুলুম করলেও তারা আমার ঈমানী ভাই। তারা ভুল করে আমার ওপর জুলুম করেছেন, কিন্তু তাই বলে আমিও তো সেই ভুল করতে পারি না। তবে, তাদের সাথে আমার মনের দূরত্ব থাকাটা অস্বাভাবিক ও অনৈসলামিক নয়।
রাসূলুল্লাহ (স) এর সাহাবী ওহশী (রা) হামযা (রা)কে ওহুদ যুদ্ধে শহীদ করেছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (স) এর সামনে আসলে রাসূলুল্লাহ (স) তাকে বলতেন- ওহশী, তুমি যখন আমার কাছে আসো, আমার দিকে মুখ না দিয়ে পেছন ফিরিয়ে বসবে। কারণ তোমাকে দেখলে আমার চাচার হত্যার কথা ভেসে ওঠে।
কিন্তু একজন সাহাবী হিসাবে রাসূলুল্লাহ (স) ওহশীকে সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন। এরপরও মানবীয় কারণেই কিছু আবেগকে তিনি প্রকাশ্যে প্রকাশ করে দিয়েছেন।
আমাদের ভেতরও এমন কিছু হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যেন কোন কারণেই ভ্রাতৃত্বের মৌলিক দাবীগুলো যেন আদায় করি। আমি যেমন কিছু লোককে অপছন্দ করি, ঠিক তেমনি এমনও কিছু লোক আছে বা থাকবে যারা আমাকেও অপছন্দ করেন। কিন্তু অপছন্দ যেন ঘৃণায় পরিণত না হয়। কাউকে হয়ত আমরা সংগত কারণে অপছন্দ করতে পারি, কিন্তু কাউকে ঘৃণা করা জায়েয নেই। আমি যাকে ঘৃণা করছি তার কোন কাজ হয়তো আল্লাহ পছন্দ করে আমার আগেই তাকে জান্নাতে দিয়ে দিবেন। ফলে, কোন জান্নাতীকে ঘৃণা করে কেউ (সহজে) জান্নাতে যেতে পারবে বলে মনে হয় না।