স্টপ জেনোসাইড ইন বার্মা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
আকবর হোসেন:
‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত’ কালজয়ী একটি লোকসঙ্গীতের এই লাইনটির উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় পল্লী সাহিত্য পড়তে গিয়ে এই লাইনটি মনে এখনো গেঁথে আছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। জানিনা তিনি কোন প্রেক্ষাপটে এই গানের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, তবে আজকের এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ, হিংসা বিদ্বেষ ভরপুর এই দুনিয়ায় এর তাৎপর্য অনেক। এখানে মানুষের রক্ত নিয়ে চলছে নিষ্ঠুর খেলা। জাতি, বর্ণ, ভাষা ও ধর্মের কারণে মানুষের উপর চলছে অবিচার-অত্যাচার। মানুষরূপী হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা অবুঝ শিশুরাও। অধিকারবঞ্চিত মানুষদের নিশ্চি? করে দিতে চায় এই অপশক্তি। জাতি ধর্মের পার্থক্য থাকলেও তারা ভুলে গেছে যে আমরা সবাই একই মায়ের সন্তান। বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভুপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন একটি অসাধারণ গান ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা, আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো, যদি দিতে পারো প্রতিদান হোক অমূল্য রত্ম তুমি পেতেও পারো’ আমরা জানি নানা বর্ণের মানুষের রক্ত কিন্তু একই রঙের। একই মায়ের উদরে আমাদের জন্ম। তাহলে কেনো এতো সংঘাত? কেনো এই রক্ত পিপাসুরা শুধু মানুষের রক্তই চায়! কেনো অত্যাচারিত, নির্যাতিত, তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষের রক্তের কোন দাম নেই! হায়েনাদের নিষ্ঠুরতায় প্রতিদিন কতো মানুষের রক্ত ঝরছে তার কোন হিসেব নেই। বার্মার রাখাইন প্রদেশ এখন বিরান ভূমি। সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার। এথনিক ক্লিনসিং এর ভয়াবহ এজেন্ডা নিয়ে সেদেশের কুখ্যাত সেনাবাহিনী উন্মত্ত হয়ে গণহত্যায় নেমেছে। তারা যুগ যুগ ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একেবারে শেষ করে দিতে চায়। রোহিঙ্গা হত্যাকারী সেনাদের সাথে যোগ দিয়েছে চরমপন্থী বৌদ্ধরা। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে দেশত্যাগ করছে লাখো লাখো রোহিঙ্গা, আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করে দেয়া হচ্ছে। স্কুলে পড়েছিলাম আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য। আজ আরাকান জ্বলছে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে সেখানে। মগের মুল্লুকের মগরা বড়ই নিষ্ঠুর। হিংসার লকলকে আগুন তাদের চোখেমুখে। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায়। প্রয়োজন শুধু মাটির। কারণ সেখানে নাকি প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া গেছে। শকুনদের লুলোপ দৃষ্টি পড়েছে সে মাটিতে। তাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা সে মাটি হাত খালি করতে চায়। বড় শক্তি আছে তাদের পেছনে।
সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের দৃশ্য বিশ্ব সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে আসছে তাতে তাদের নৃশংসতার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ভয়াবহ সে দৃশ্যগুলো দেখে। তাদের আক্রমণ এতোই নির্মম যে এসব চিত্র দেখে অনেকেরই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। আহারে! কোন মানুষ কোন মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে? আর সারা বিশ্ব নীরবে তাকিয়ে দেখছে এসব হত্যাকান্ড। মুসলিম বিশ্বের শাসকবর্গ তাদের ক্ষমতার মসনদ নিয়ে ব্যস্ত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান যে দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলছেন এবং রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন সে তুলনায় অন্যদের ভূমিকা তেমন জোরালো নয়। দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো সন্ত্রাস দমনের নামে বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে হলেও বাণিজ্য চাই। ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকার কোন প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ইরাককে বিরান করা হলো। আফগানিস্তান ও লিবিয়িারও একই অবস্থা। কর্পোরেট শক্তির স্বার্থের জন্য তারা সবকিছুই করতে পারে। বার্মাতে নাকি চীনের স্বার্থ রয়েছে। তবে সময়ই বলে দেবে আসলে কার স্বার্থ কোথায়! রাখাইন রাজ্যে কোন মানুষ থাকার প্রয়োজন নেই বিশেষ করে মুসলমানদের। যেনো মুসলমানের কোন মানবাধিকার থাকতে নেই। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নারী-পুরুষ এমনকি শিশুদের। মানুষ কি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? এই নিষ্ঠুরতা দিয়েই তারা অন্য মানুষদের শেষ করে দিতে চায়। ফিলিস্তিনকে যেভাবে গ্রাস করছে ইজরাইল, হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, তাদেরকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, নিজের আবাসভূমি জবরদখল করছে তারচেয়েও জঘন্য কায়দায় আজ রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বার্মিজ সেনাবাহিনী। তারা শুধু রাখাইনের মাটিই চায় আর কিছু চায় না।
বিশ্ব মোড়লরা চাইলে এক হুংকারে হত্যাকান্ড থামাতে পারে। কিন্তু তারা তা করছে না। ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানে আক্রমণ করতে তাদের সময় লাগে না অথচ বার্মায় প্রকাশ্যে চলছে গণহত্যা। অথচ সবাই নিশ্চুপ! গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার এর ধ্বজাধারীরা আজ কোথায়? ইউরোপ আমেরিকায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ট্যাবলেট বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যদেশে তা রক্ত দিয়েও পাওয়া যায় না। হায়রে দু‘মুখো নীতি! অন্যরা মরুক তাতে তাদেও কিছু আসে যায় না। নিজের স্বার্থ থাকলে ভিন্ন কথা। এই দু’মুখো নীতির বলি হচ্ছে দুনিয়ার অগণিত মানুষ। অধিকারবঞ্চিত মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে যখন আর কিছু করার থাকেনা তখন কেউ কেউ ভিন্ন পথে চলে যায়। এর কারণে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। তারা তখন পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তি পাগল মানুষের এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে আমরা বলি ‘সন্ত্রাস’। আসলে পাশ্চাত্যের মানুষের জীবনের মূল্য আছে। এখানে কোন সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় হুলস্থুল পড়ে যায়। সারাক্ষণ এনিয়ে বিভিন্ন নিউজ থাকে, ঘটনা বিশ্লেষণে প্রচারিত হয় নানা টকশো’। মানবতাবাদী আমরা সবাই সোচ্চার হই, প্রতিবাদ করি, নিন্দা জানাই। অথচ প্রতিদিনই সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেনে মানুষের রক্তগঙ্গা বইছে। বসনিয়া, রুয়ান্ডা, গুজরাট, সুদান, সোমালিয়ায়ও কতো মাসাকার হলো। কতো জীবন চলে গেলো তার কি কোন হিসেব আছে? এসবের মূল ভিকটিম হচ্ছে মুসলমান। কারণ মুসলমানের রক্তের কোন দাম নেই। মুসলিম নামধারী কেউ সন্ত্রাসী হলে তার ধর্মের নাম উল্লেখ করা হয় কিন্তু সন্ত্রাসী যখন অন্য ধর্মের হয় তখন তার নামের সাথে ধর্মীয় পরিচয় আসে না।
সেদিন এটিএন বাংলায় সাংবাদিক মুন্নী সাহার প্রশ্নের জবাবে একজন রোহিঙ্গা যুবক তার উপর নির্যাতন বিষয়ে বললো, যেহেতু তারা মুসলমান সে কারণেই তাদের উপর এই হত্যাকান্ড, সেদেশে তাদের কোন অধিকার নেই। সেদেশের ভাষা শেখারও কোন সুযোগ নেই। ক্লাস ফাইভ শেষে আর কোন পড়াশুনার সুযোগ নেই। তার মানে মুসলমান হবার কারণে তাদের কোন মানবাধিকার নেই। ৪/৫ বছর আগে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৈয়দ জুবায়ের আহমদ নির্মিত দ্যা ফ্লোটিং ম্যান নামক একটি শর্ট ফিল্ম এর প্রিমিয়ার শো’ দেখলাম। ইস্ট লন্ডনের ষ্টেপনীগ্রীনস্থ জেনেসিস সিনেমাহলের পর্দায় ছবিটি দেখে অনেকেই কেঁদেছেন। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা ডুবে গেলে ৩৩ জনের লাশ উদ্ধার এবং তাদের মাঝে ১ জনের বেঁচে যাবার ঘটনা নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বঞ্চিত জীবনের এক করুণ ইতিহাস ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে। আসলে সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। রোহিঙ্গাদের সেদেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়না। তাদের ভোটাধিকার নেই। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পাস লাগে। বিয়ে করতেও বার্মিজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। দেশের ভেতর অবাধ চলাফেরায় আছে নিষেধাজ্ঞা। এভাবে কী একটি জনগোষ্ঠী জীবনযাপন করতে পারে? এরকম বর্বরতার শিকার যদি অন্য কোন ধর্মের মানুষ হতো তাহলে কী হতো? ইস্ট তিমুরকে তো স্বাধীনই করে দেয়া হলো। রোহিঙ্গারা তো সেখানে কোন স্বাধীনতা চাচ্ছেনা। তারা চাচ্ছে শুধু তাদেরকে বার্মিজ নাগরিক হিসেবে নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে নিজের দেশে বসবাস করতে। কিন্তু তাদেও সেই নূন্যতম অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে বুলেট দিয়ে। এজন্যই কি দুনিয়ার মানুষ সংগ্রাম করেছিলো সুচির জন্য? অং সাং সুচির মুক্তির দাবিতে সারাবিশ্ব ছিলো প্রতিবাদমুখর। অথচ সেই সুচির দেশে আমরা এখন কী দেখছি? শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়ে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাইতো আজ সর্বত্র তার সেই নোবেল প্রাইজ বাতিলের দাবি উঠেছে।
বিশ্ব মোড়লেরা কিছু করুক না করুক সেদিকে চেয়ে নেই দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ। তারা জেগে উঠেছে। দেশে দেশে চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। আমরা সেই অন্যায়কে সয়ে যেতে পারিনা। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে অগণিত হৃদয়বান মানুষ। মানবতাবাদী শিল্পী ভূপেন হাজারিকার আরেকটি বিখ্যাত গান ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবনের জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনা, অ বন্ধু’ এই অনুভূতিতে জেগে উঠেছে মানব হৃদয়। রাখাইনে মানবতার চরম বিপর্যয়ে বিবেকবান মানুষ বসে থাকতে পারেনা। সে দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যেখানেই অন্যায় অবিচার সেখানেই রয়েছে বিবেকবান মানুষের কণ্ঠ সোচ্চার স্টপ জেনোসাইড ইন বার্মা! স্টপ কিলিং ইননোসেন্ট পিপল! স্টপ ট্রেনিং বার্মিজ আর্মি, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট পিস! পরিশেষে বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং এর একটি ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই ‘ইনজাস্টিস অ্যানিহোয়ার ইজ এ থ্রেট টু জাস্টিস এভরিহোয়ার।’
লন্ডন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭.
আকবার হোসেন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।