জ্বলছে রাখাইন, মানবতা জাদুঘরে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে রাখাইন রাজ্য, পুড়ে ছারখার হচ্ছে শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতী ও বুড়ো মানুষের সতেজ প্রাণ। এটা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা গনতন্ত্রের লেবাসদারী, স্বৈরচারিনী অং সাং সুচীর নিষ্টুরতা, বর্বরতা,ও পাশবিকতা যা মধযযুগীয় বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে । যে কোন যুদ্ধ বা বিপর্যয় দেখা দিলে বিপদগ্রস্ত মানুষ প্রাণ বাঁচানোর আশায় পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয় যা কখনও সে দেশের জন্য কল্যাণকর বা কাম্য নয় । কিন্ত মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে ঐ নিপীড়িত জনগোষ্টির পাশে দাঁড়ানো বা আশ্রয় দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই, যা ১৯৭১ সালে ভারত আমাদেরকে আশ্রয়, সহযোগিতা সবই করেছিল, এটা ছিল ভারতের রাজনৈতিক দুরদর্শিতা, যা থেকে রাজনৈতিকভাবে এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও ভারত লাভবান হয়েছিল বা এখনও হচ্ছে। তার পরও এ দুর্দিনে বাঙালিরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, এর জন্য বাংলাদেশীরা কৃতজ্ঞ। যার পাওনা আজও শোধ করে যাচ্ছি। আমি আজ আর সেদিকে যাচ্ছি না।
আমাদের দেশে মানবতাবাদীরা আজ কোথায়? তাদের নিরবতা ও শরনার্থীদের প্রতি বিষোদগার হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয় । যারা ৭১ মানবতা বিরোধী আপরাধের বিচারের জন্য সোচ্চার ছিল, তাদের নৈতিক অবস্থান বা চেতনা তো এ ধরনের অপরাধের বেলায় অপরিবর্তিত থাকার কথা। হউক সে অপরাধ বার্মা, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর কিংবা সিরিয়ায়। তাদের নিষ্কৃয়তা প্রমান করে তাদের কথিত মানবতা বিরোধী অবস্থান ছিল শুধু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিবেচনায় একটি গোষ্টিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। চেতনাবাজদের অন্যতম শাহরিয়ার কবিরের একটি টক শো দেখলাম। রোহিঙ্গার নিরস্ত্র, নিরাপরাধ, সংখ্যালঘু মুসলমানদের শাহরিয়ার কবির সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত ও চীনের সাথে কোয়ালিশন করে অং সাং সুচীর সরকারকে সহযোগিতা করে ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নির্মুল করার সবক দিচ্ছেন । শুধু তাই নয়, তার ভাষায় এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আমাদের দেশের দুটি রাজনৈতিক দলের ইন্দনে (বিএন পি/জামাত) এ সব কর্মকাণ্ড চলিয়ে যাচ্ছে । তার কথা শুনে আমি হতবাক, আমার বিবেক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, নিজের দেশকে জড়ানো কতটা নির্বুদ্ধিতা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । আমি মনে করি এটি দেশদ্রোহীতার শামিল। এসব মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের বিচারের অপেক্ষায় রইলাম । হয়তোবা সেদিন আর খুব বেশি দুরে নয়।
রোহিঙ্গা শরনার্থি আমাদের জন্য এক বিরাট সমস্যা। আর এ সমস্যার সমাধান কাঁটাতারের বেড়া, বিজিবি’র পাহারা, সিমান্ত চৌকি কিংবা অসহায় মানুষদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলে হবে না। এ জন্য দরকার কুটনৈতিক তৎপরতা । বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিরবতা লক্ষনীয়, দেখা যাচ্ছে মানবতার অবস্থান স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন । কী এক নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানবতা । আমেরিকা, ভারত এবং চীন এ সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়, কেননা মিয়ানমার সরকারের সাথে তাদের নতুন বানিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর ভারত চাইবে সমস্যাটি জিইয়ে রাখলে বাংলাদেশ সব সময় একটা চাপের মধ্যে থাকবে এবং ভারত ইস্যু ভিত্তিক দরকষাকষি করে বাংলাদেশের কাছ থেকে ফায়দা আদায় করতে পারবে ।
সুতরাং বাংলাদেশকে নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। প্রথমত জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ও.আই.সি ইত্যাদির মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের উপর এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়াও টার্কি, মালোয়িশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিয়ে নতুন জোট করা যেতে পারে । এটি আমাদের জন্য একটি জাতীয় সমস্যা, আর এ সমস্যা চলতে থাকলে আমাদের সার্বভৌমত্তের উপর আঘাত হতে পারে, বিধায় এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করার সুযোগ নেই। সরকার, বিরোধীদল, মানবাধিকার কর্মী এবং সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে ড. ইউনুসের মত লোককে জাতির দুর্দিনে লবিং এর জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। আশা করব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যপারে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, তার দুরদর্শিতায় জাতি এ সংকট থেকে রেহাই পাবে এবং নিরপরাধ, নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে মানবিক মর্যাদা লাভ করবে।
লেখক : বৃটিশ-বাংলাদেশী ব্যাংকার, কলামিস্ট