ফিলিস্তিন : ভুলতেবসা এক নির্যাতিত জনপদের নাম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুলাই ২০১৭
জুবায়ের আহমেদ: আবারো মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদে প্রবেশে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে দখলদার ইসরাইলী রাষ্ট্র। চলতি জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মসজিদ প্রাঙ্গণে দু’জন ইসরাইলী পুলিশ নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে এ কঠোরতা আরোপ করল ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ।
এরই সুত্র ধরে গত ২১ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের সময় আল-আকসা মসজিদের ভেতর ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন মুসল্লীরা। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সংঘর্ষের সুত্রপাত ঘটে। পুলিশ এ সময় মুসল্লীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস, বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকলে বুলেটের আঘাতে ঘটনাস্থলেই এক যুবক নিহত হন। মসজিদ প্রাঙ্গণে লাঠিচার্জ, কাঁদানের গ্যাস ছুড়ার ফলে আরও ৫শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এছাড়া পশ্চিম তীর ও অন্যান্য জায়গায় ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও দু’যুবক নিহত হয়েছেন ওইদিন।
এরপর থেকেই ফিলিস্তিন জুড়ে প্রতিদিনই সংঘর্ষ চলে আসছে পুলিশ ও ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সেখানকার অধিবাসিদের। পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশীর নামে হামলা করছে ফিলিস্তিনিদের উপর। এসব বর্বর হামলার হাত থেকে রক্ষা পাননি বৃদ্ধ মহিলা থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশু পর্যন্ত। এছাড়া অসংখ্য ফিলিস্তিনি যুবককে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলী পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। কতদিন যে ইসরাইলী জেলের গ্লানী টানতে হবে তাদের, তারও কোনো সঠিক হিসেব জানা নেই কারও।
হয়েতা এর সুত্র ধরে আবারো অসংখ্য ফিলিস্তিনি মায়ের বুক খালি হবে, চোখের সামনে ধরে নিয়ে যাবে আপন বুকের মানিককে; যার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এক সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া হয়ে যাবে কিন্তু সে মানিকের আর ফেরা হবে না। বছরের পর বছর ধরে তাদের আটকে রাখা হবে ইসরাইলী বন্দি কারাগারে। শুধুমাত্র বুলেটের বিপরীতে কয়েকটি পাথর নিক্ষেপের কারণেই তাদের এসব শাস্তি ভোগ করতে হবে। নিজ দেশে আজ যারা পরবাসী এরাই দখলদার ইসরাইলীদের চোখে ভয়ংকর সন্ত্রাসী।
ইসরাইলের জারিকৃত বিধি-নিষেধের মধ্যে অন্যতম হল ৫০ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি আল-আকসা মসজিদের ভেতর প্রবেশ করতে পারবেন না। মসজিদের প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে মেটাল ডিডেক্টর। এতে করে যে কেউ মসজিদের ভেতরে ঢুকতে চাইবে তাকে ওই মেটাল ডিটেক্টরের তল্লাশী শেষেই কেবল ঢুকতে হবে। সাথে মসজিদ প্রাঙ্গণে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা।
আল-আকসা শুধুমাত্র একটি মসজিদেই নয়, মর্যাদার দিক দিয়ে মসজিদে হারমাইন ও মসজিদে নববীর পরেই যার অবস্থান এবং মুসলিম মিল্লাতের প্রথম কিবলাহ। এই মসজিদের উপর হামলা বা বিধিনিষেধ আরোপ করা সমগ্র মুসলিম জাতির সাথে তামাশা করার সামিল। প্রতিটি মুসলমানের উচিত যার যার সাধ্যমত এর প্রতিবাদ করা। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে কুটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা যাতে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ নিয়ে দখলদার ইসরাইল কোন ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করতে না পারে।
ফিলিস্তিনই পৃথিবীর একমাত্র জনপদ যেখানকার মানুষ পূথিবীর সবচেয়ে অসহায়, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। যে ভূখন্ডের মানুষ স্বপ্ন গড়ে শুধু ভাঙ্গার জন্য। যেখানকার শিশুদের সকালের ঘুম ভাঙ্গে বোমা অথবা বুলেটের আওয়াজ শোনে। যারা গত সত্তোর বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে দখলদার ইসরাইলিদের হাতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় মধ্যপ্রাচের ফিলিস্তিন ভূখন্ডে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ এই প্রস্তাব পাশ করে ওই ভূখন্ডের মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল নামক দখলদার রাষ্ট্র বৈধতা লাভ করে।
এরপর থেকেই নানাভাবে ফিলিস্তিনীদের উপর নির্যাতন, ভয়ভীতির মাধ্যমে তাদের আরও ভূখন্ড দখল করে নেয়ার কৌশল অবলম্বন করে ইসরাইল। যার ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। কখনও আকাশ পথে বিমান হামলা, কখনও বা স্থল পথে বুলডোজার দিয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দখল করে নেওয়াই তাদের কৌশল।
ফিলিস্তিনকে দুর্বল করতে ইসরাইল বরাবরই মানবতা, সভ্যতা, ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমেই তারা ফিলিস্তিনীদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করতে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার চেষ্টা করে। তাতে তারা সফলও হয়। আমরা অবাক বিস্ময়ে মজলুম ফিলিস্তিনীদের হামাস ও ফাতাহ্ এ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত হতে দেখেছি।
ফাতাহ্ অনেকটা পাশ্চাত্য ধাঁচের, আচরণে এবং নীতি-কৌশলে। কিন্তু হামাস প্রথম থেকেই প্রতিবাদী ও জাতীয়তাবাদী। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা, মুক্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হামাস সশস্ত্র সংগ্রামে রত।
ইসরাঈল শুধু ফিলিস্তিনে নয়; সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোকে বিভক্ত রাখতে সদা তৎপর তার নিজেরই স্বার্থে।
আজ ফিলিস্তিনী জাতির উপর কোনও হামলা বা আক্রমণ হলে মুসলিম বিশ্ব আগের মত তেমন প্রতিবাদে গর্জে উঠে না। এখন আর আগের মত ফিলিস্তিনী জনগনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে না। শুধুমাত্র নামে মাত্র কিছু বিবৃতির মধ্যে সবকিছু সীমাবদ্ধ থাকে। সব কিছুতে যেন একটা দায়সারা ভাব।
জাতিসংঘ ওআইসিসহ অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার ভূমিকাও একই। ইসরইল ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে তারা ব্যর্থ। সাথে ব্যর্থ হয়েছে দেশে দেশে শান্তির ফেরি করে বেড়ানো বিশ্ব মোড়লরাও।
আল-আকসা সমস্যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ৫৭টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ওআইসির ভূমিকা সবসময়ই ছিল প্রশ্নবৃদ্ধ। তারা মুসলিম জাতির দাবি পূরণে ও সবাইকে একপ্লাটফর্মে নিয়ে আসতে সম্পূর্নরুপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব তেলন্ডারের ৬০ শতাংশ এলাকা হচ্ছে আরবলীগের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোর। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তি আরবলীগের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। অথচ তারাই কিনা নানা অভ্যন্তরীণ সম্যসায় জর্জরিত।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যা সমাধানে নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করলেও তারা যে ইসরাইলী স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে সেটা জনগণের বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়না। তাদের এমন দ্বৈতনীতির ফলেই আজ পর্যন্ত সংকট থেকে উত্তরণের সঠিক কোনো সমাধান বেরিয়ে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রতি বছর তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে থাকে ইসরাইলকে। ইসরাইলের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় চাইলেই এগুলো ব্যবহার করতে পারে তারা।
বহুবার ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসেছিলেন বিশ্ব সম্প্রদায়। অতীতে কোনও আলোচনাই ফলপ্রসু হয়নি একমাত্র ইসরাইলের একচোখা নীতির কারণে।
সর্বশেষ এ বছরের প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার পুনর্নিশ্চিত করতেই মূলত এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ফ্রান্স।
ফিলিস্তিন এ শান্তি আলোচনাকে স্বাগত জানালেও ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটাকে প্রতারণামূলক আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যই হল ইসরাইলের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করা। এবং এ সম্মেলন আমাদেরকে কিছু করতে বাধ্য করতে পারবে না। এভাবেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বার বার অপমান করে আসছে তারা।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বসত নির্মাণকে অবৈধ ঘোষনা দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইসরাইল যে বসতি স্থাপন করে আসছে, এর কোন আইনি ভিত্তি নেই।
১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে তা পাস হয়। ভোট দান থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে অতীতে তারা ইসরাইল বিরোধী প্রস্তাবগুলোতে সবসময় ভেটো দিয়ে আসত।
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ইসরাইলী সমস্যার সমাধানে বিশ্ব শক্তিকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষকরে পাশ্চাতের সৃষ্ট এ সমস্যা সমাধানে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।
হয়তো একদিন ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হতে পারে, তবে তা কবে? কীভাবে? তার সঠিক কোন উত্তর কারো জানা নেই।
লেখক: চিফ রিপোর্টার, এলবি২৪.টিভি, লন্ডন।
ইমেইল: jubaerahmed@journalist.com