টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র নির্বাচন-২০১৮ : স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভবিষ্যত কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৭
জিবরান চৌধুরী: মধ্যবর্তী নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটসের দুটো আসনের স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর ফলাফল নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছিলাম, কিন্ত সময়ের অভাবে নির্বাচনের পর পর লেখা সম্ভব হয়নি। দেরিতে হলেও এ বিষয়ে কিছু লেখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
এবারের নির্বাচনে বেথনাল গ্রীন এণ্ড বো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আজমাল মাসরুর। আর পপলার এণ্ড লাইম হাউজে ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস ইণ্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের লীডার কাউন্সিলার অলিউর রহমান। এই দুই প্রার্থীর মধ্যে আজমাল মাসরুরকে নিয়ে বেথনাল গ্রীন এণ্ড বো আসনে তাঁর সমর্থকেরা বেশ আশাবাদী ছিলেন যে, তিনি একটা চমক দেখাতে পারবেন। অনেকেই মনে করেছিলেন তিনি লেবার প্রার্থী রুশানারা আলীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উত্তীর্ণ হবেন।
কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেলো, আজমাল মাসরুর মাত্র ৩,৮৮৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য মধ্যবর্তী আকস্মিক নির্বাচনে মাত্র চার সপ্তাহ ক্যাম্পেইন করে এই ভোট যোগাড় করা একেবারেই খেলনা নয়। কিন্তু যেহেতু আজমাল মাসরুল একজন টিভি ব্যক্তিত্ব এবং বিগত দিনে এই আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভালো ফলাফল করার রেকর্ড রয়েছে তাই এই ভোট তার জন্য নগন্যই বলা চলে। কারণ ২০১০ সালের নির্বাচনে লিবডেম থেকে প্রার্থী হয়ে বর্তমান লেবার এমপির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি ১০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন।
অন্যদিকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের লীডার কাউন্সিলার অলিউর রহমান পপলার এন্ড লাইম হাউজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১,৪৭৭ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে ঠাঁই করে নিয়েছেন। যেখানে বিজয়ী লেবার প্রার্থী জিম ফিজপ্যাট্রিক পেয়েছেন ৩৯,৫৫৮ ভোট, সেখানে ১৪৭৭ ভোট প্রাপ্তি কোনোভাবে নগন্যের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আজমাল মাসরুরের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দিয়েছে কাউন্সিলার রাবিনা খানের নেতৃত্বাধীন টাওয়ার হ্যামলেটস পিপলস অ্যালায়েন্স। তাছাড়া টাওয়ার হ্যামলেটস লেবারের একটি বঞ্চিত গ্রুপও অপ্রকাশ্যে ক্যাম্পেইন করেছে।
টাওয়ার হ্যামলেটস পিপলস অ্যালায়েন্স সদস্যরা একসময় টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে টাওয়ার হ্যামলেটসের আগামী মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক গ্রুপের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হলেন সাবেক ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলার অহিদ আহমদ। অপর গ্রুপে রয়েছেন পিপলস অ্যালায়েন্সের নেত্রী সাবেক হাউজিং লীড মেম্বার কাউন্সিলার রাবিনা খান। দুই গ্রুপে দুই প্রার্থী নিজেদেরকে ২০১৮ সালের জন্য মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করে পৃথক পৃথক ক্যাম্পেইন অব্যাহত রেখেছেন। অপরদিকে অলিউর রহমানের পক্ষে কাজ করেছে সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান সমর্থিত টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ। দুই প্রার্থীর পক্ষে দুটো গ্রুপ কাজ করার পরও ভোট প্রাপ্তি রীতিমতো হতাশাজনক। নির্বাচনে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর শোচনীয় ফলাফল টাওয়ার হ্যামলেটসের আগামী মেয়র নির্বাচনে সম্ভাব্য দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কী বার্তা দিয়ে গেলো-এটাই আজকের লেখার মূল বিষয়বস্তু।
টাওয়ার হ্যামলেটসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায়। মূলধারার রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হওয়া যায়-তা প্রমাণ করেছিলেন সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান। ২০১০ সালে লেবার পার্টি যখন তাঁর নমিনেশন কেড়ে নেয় তখন তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হয়ে তা দেখিয়ে দেন। লৎফুর রহমানের এই বিজয় থেকেই মূলত অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্র্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উদ্ধুদ্ধ হন। অনেকেই মনে করেন লুৎফুর রহমান যদি স্বতন্ত্র হিসেবে দুইবার মেয়র নির্বাচিত হতে পারেন তাহলে আমি পারবো না কেন? কিন্তু প্রচণ্ড আশাবাদী এই ব্যক্তিরা লুৎফুর রহমানের সময়ের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমলে নিতে চান না।
২০১০ সালে লুৎফুর রহমান নির্বাচিত হওয়ার পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। প্রথমত তিনি লেবার পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর অন্যায়ভাবে তাঁর নমিনেশন কেড়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত তাঁর বিরুদ্ধে লেবার পার্টির নির্বাহী কমিটিতে যে অভিযোগ দেয়া হয়েছিলো সেখানে ক্বাবা শরীফের ইমামকে জড়ানো হয়েছিলো। বলা হয়েছিলেন, লুৎফুর রহমান লীডার থাকাকালে ক্বাবার ইমাম টাউন হল পরিদর্শন করেছেন। সৌদি আরবের একজন ইসলামি স্কলারের এভাবে টাউন হল পরিদর্শনকে স্থানীয় এক লেবার নেতা সন্দেহজনক উল্লেখ করে অভিযোগ করেছিলেন। তাই লুৎফুর রহমানের মানোনয়ন বাতিল করা হয়। বাংলা মিডিয়া তখন কমিউনিটির সম্মুখে বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরে। মানুষ বুঝতে পারে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে লেবার পার্টি অন্যায় করেছে। তাছাড়া ক্বাবা শরীফের ইমামকে টাউন হলে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে তাঁকে চরমপন্থী হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্টার বিষয়টি মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হানে। তখন দলমত নির্বিশেষে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। ফলশ্রুতিতে লুৎফুর রহমান বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তিনি লেবার প্রার্থী হেলাল আববাসের চেয়ে ১২ হাজার ২৯ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তিনি পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ২৮৩ ভোট। লেবার প্রার্থী হেলাল আববাস পেয়েছিলেন ১১ হাজার ২৫৪ ভোট। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই বিশাল জয়ের ধারা অব্যাহত ছিলো না। ওই নির্বাচনে লুৎফুর রহমান দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেও বিজিত প্রার্থীর সাথে ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ২,৬৫২।
এর পরের কেচ্ছা সকলেরই জানা। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল নির্বাচনী আদালতের রায়ে লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদ হারাতে হয়। নির্বাচনী আদালতে লুৎফুর রহমানের মেয়র পদ হারানোর পর একের পর এক তাঁকে মেয়র হওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে। নিজের আইন পেশার লাইসেন্স হারাতে হয়েছে। মামলার খরচ বহন করতে গিয়ে ঘর হারাতে হয়েছে। কোনো দিকেই যখন আশার আলো নেই তখন মেট্রোপলিটন পুলিশ আশাব্যঞ্জক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ দীর্ঘ এক বছর তদন্ত করে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধের কোনো প্রমাণাদী পায়নি। এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে লুৎফুর রহমান রায়ের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে। এখন লুৎফুর রহমানের সম্মুখে আর কোনো রাস্তা খোলা আছে কি-না জানি না। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, লুৎফুর রহমানের অবস্থা যত খারাফ হবে ইণ্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের অবস্থাও হবে ততৈবচ। কারণ এই গ্রুপটি তাঁর হাতেগড়া। মেয়র জন বিগসের ক্রমাগত ফান্ডিং কাটের কারণে টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ আগামী নির্বাচনে যদিও বিকল্প খুঁজছে কিন্তু ইণ্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের বিভক্তির কারণে তাঁদের সম্মুখে আপাতত কোনো বিকল্প নেই। একসময় যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপে ১৭ জন কাউন্সিলার ছিলেন এখন সেখানে রয়েছেন এক গ্রুপে ৯ জন, অন্য গ্রুপে ৫ জন। বাকীরা ঝরে পড়েছেন। কেউ লেবার পার্টিতে ফিরে যাওয়ার আশায় নিজেকে ইণ্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার কাউকে বিদায় নিতে হয়েছে দূর্নীতির দায়ে।
যে ১৪ জন ইণ্ডিপেন্ডেন্ট কাউন্সিলার আছেন তারা একটি গ্রুপে থাকলে আশা ছিলো। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আশার আলো একেবারেই ক্ষীণ। মধ্যবর্তী নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটসে দুই ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থীর শোচনীয় ফলাফল প্রমাণ করে আগামী মেয়র নির্বাচনে দুই ইণ্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ একীভূত হয়ে একক প্রার্থী দিলেও লেবার প্রার্থী জন বিগসের সাথে লড়াই করে বিজয়ী হওয়া কঠিন। উপরন্তু দুই গ্রুপ থেকে দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে জন বিগস বিপুল ভোটে পুননির্বাচিত হবেন-এটাই শতভাগ সত্য। তাই কমিউনিটির স্বার্থে দুই গ্রুপ একীভূত হয়ে একক প্রার্থী ঘোষণার কোনো বিকল্প নেই। ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে হবে। তবেই আগামী নির্বাচনে একজন বাঙালি মেয়র পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। নতুবা জন বিগসের সাথে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার প্রত্যাশা হবে আকাশ কুসম কল্পণা।