ছোটবেলার ঈদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০১৭
আকবর হোসেন:
আর মাত্র ক’দিন পরেই আসছে ঈদ। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আমরা ঈদের খুশিতে মেতে উঠবো। ঈদ আসে বছরে দু’বার। ঈদ আসে ঈদ যায়। হায়! কতদিন হলো বাড়িতে সবার সাথে ঈদ করা হয়নি। ঈদ এলেই ছোটবেলার ঈদের কথা মনে পড়ে। আগের দিনের ঈদের আমেজ ও আনন্দ সত্যি খুবই মিস করি। বিলেতে ঈদের আনন্দ যে একেবারে উপভোগ করি না তা কিন্তু নয়। আমাদের এখানে ঈদগাহ না থাকলেও ঈদ ইন দ্যা পার্ক আমাদেরকে জামাতে নামাজের সুযোগ এনে দিয়েছে। পার্কে ঈদ উদ্যাপন দেশের মতো ঈদগাহে নামাজ আদায়ের সেই আমেজ ও অনুভূতি অনেকটা পূরণ করেছে। তারপরও ঈদ এলে কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে যাই। সেই ছোটবেলার ঈদই আমাদের কাছে ছিলো অনেক উৎসবমুখর এবং খুবই আনন্দের। এ নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা এখানে তুলে ধরবো।
১৫ রোজা যাবার পরপরই শুরু হতো কাউন্টডাউন। কবে হচ্ছে ঈদ। নতুন কাপড় পরার এক অদম্য বাসনা মনে। সে অনুযায়ী বাজারে টেইলারের দোকানে শার্টের অর্ডার দেয়া হতো। সে সময় একটি বড়ো দুঃশ্চিন্তার বিষয় ছিলো যদি সময়মতো কাপড় ডেলিভারী না পাই। শার্টের মাপজোক দেয়ার পর টেইলারের দোকানে মাঝে মধ্যে আবার চক্কর দিয়ে আসতাম। চেক করতাম আমাদের কাপড় সেলাই হচ্ছে কিনা। তখন তো আর রেডিমেইডের এতো প্রচলন ছিলো না। ঈদের একদিন পূর্বে কাপড় ডেলিভারী পেয়ে মনে কী যে সুখানুভূতি পেতাম! তারপর এটা ভাজ করে বালিশের নিচে রাখতাম। পরেরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গতেই গলা ফাটিয়ে আওয়াজ দিতাম -আজ ঈদ! বাড়ির পুকুরে গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে নামাজের জন্য তৈরি হতাম। আর ঈদের আগেই আমাদের চুল কাটা হতো এবং আম্মা হাত-পায়ের নখগুলোও কেটে দিতেন। ঈদে সন্দেশ, বড়া, নারিকেলের সমশা, সেমাই ইত্যাদি তৈরি করা হতো।
এ উপলক্ষে চাল ভিজিয়ে নরম করে গাইল ও ছিয়া দিয়ে গুড়ো করা হতো। ঈদের চাঁদের হিসেব করে চাল ভিজানো হতো। একদিন বেশ কম হলে হয় তাড়াতাড়ি সন্দেশ বানানো লাগতো অথবা একদিন দেরি হয়ে যেতো। অর্থাৎ রোজা ২৯ দিনে হলে সমস্যাটা হতো। ঈদের পিঠার মধ্যে সন্দেশ ছিলো আমাদের কাছে খুবই প্রিয়। অনেক রাত পর্যন্ত আম্মা সন্দেশ বানাতেন। আমি তার পাশে বসে সন্দেশ বানানোর দৃশ্য উপভোগ করতাম। আর গরম গরম সন্দেশ সাবাড় করতাম। কতদিন হলো সেই সন্দেশ ফুলে উঠার দৃশ্য দেখিনি! আম্মা বলতেন, পুরুষ মানুষ পাশে থাকলে নাকি ‘ছুইত’ লাগি যায়। সন্দেশ ফুলে উঠেনা। কিন্তু আমি পাশে বসে প্রমাণ করতাম যে সেটি মিথ্যা শুধুই এক ধরণের কুসংস্কার। ঈদের জামায়াতে দলবেধে যাওয়াটাও ছিলো অনেক আনন্দের। চতুর্দিক থেকে নব সাজে সজ্জিত মানুষেরা ঈদগাহে জড়ো হতেন। সবাই এক কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যেতেন। এখানে মানুষে মানুষে নেই কোন ভেদাভেদ, নেই কোন হিংসা-বিদ্বেষ। তারপর ঈদের নামাজ হতো। ইমাম সাহেবের খুতবা ও দোআর পর একে অন্যের সাথে আলিঙ্গন ও কোলাকুলির দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। কেউ কেউ আবার নামাজ মিস্ও করতেন। আবার কেউ কেউ কোন রকমে এসে নামাজ ধরতেন। নামাজ শুরুর আগে সকলেই একে অন্যের খোঁজ-খবর নিতেন। অমুক এসেছেন কিনা, আর কেউ বাকী আছেন কিনা। মজার ব্যাপার হলো আমাদের এক খালু ঈদগাহে আসতে প্রায়ই দেরি করতেন। তার জন্য সকলেই অপেক্ষা করতেন। কারণ তিনি এসে শরীক হলে ধরে নেয়া হতো যে নামাজে এসে পৌঁছার আর কেউ বাকি নেই।
ঈদগাহ থেকে বাড়িতে গিয়ে সবাইকে সালাম করতাম। তারপর দলবেধে এ বাড়ি ও বাড়ি যাবার পালা শুরু হতো। মুরুব্বীদের সালাম করতাম, সন্দেশ পিঠা খেতাম। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। ঈদের দিনের কর্মসূচীতে কবর জিয়ারতও অন্তর্ভ্ক্তূ ছিলো। সবকিছু শেষে যখন দিন ফুরিয়ে আসতো তখন খুবই খারাপ লাগতো। দিনটি আরো লম্বা হলে যেনো আরো ভালো লাগতো, আরো উপভোগ করতে পারতাম। আজ আর সেদিন নেই! ছোটবেলার ঈদের আনন্দ কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। আমাদের বাচ্চাদের কাছে এই অনুভূতিগুলো শেয়ার করলে তারাও আমাদের সেই আনন্দের শিহরণ অনুভব করতে পারবে বলে মনে করি। আজ চতুর্দিকে অশান্তি। অন্যায় যুদ্ধ ও সন্ত্রাস আমাদের শান্তি ও আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। মানবতা আজ বিপর্যস্ত। তবুও সবার জন্য শুভ কামনা। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক লন্ডন