বাবা দিবসে বিক্ষিপ্ত কথামালা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০১৭
তারেক চৌধুরী:
আজ বাবা দিবস। আমার বাবাকে ডাকতাম ’ আব্বা’। আল্লাহর বাড়ি চলে গেছেন এক দশকের কাছাকাছি। আব্বাকে মনে হতো ম্যাজিস্ট্রেটের মতো। এখনকার মত এত বাপ্ ছেলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখনোই ছিল না। ভয় পেতাম, ভালোবাসতাম তবে মাখামাখি কোনো সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্কটা ছিল শ্রদ্ধার আর স্নেহের। স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিন দশকের বেশি সময় আর মোট শিক্ষকতায় ছিলেন চার দশকের বেশি সময়। চলিশের দশকে গ্রাজুয়েশন করে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। ছাত্ররা বাঘের মত ভয় পেত। ছাত্ররা অপরাধ করুক বা না করুক-যত দূর সম্ভব তাঁর চোখের সামনে না পড়ার চেষ্টা করতো সবাই। রাস্তায় সাইকেল নিয়ে এলে সম্মুখ দিক থেকে আসুক বা পেছন দিক থেকে আসুক কমপক্ষে কয়েক শ’ গজ দূর থেকে বা অনেক দূর থেকে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যেতো ছাত্ররা।
আব্বা মৌলভী ছিলেন না, তবে অনেকেই মৌলভী ভাবতো। আরবী বা ইংরেজি পড়ায় ভুল থাকলে অন্য রুম থেকে ভুল ধরতে পারতেন। আমরা জোরে জোরে পড়তাম। ঘরে বেশির ভাগ সময় জামাতে নামাজ হতো। আব্বা ইমামতি করতেন বাসায় এবং স্কুলে যখন ধর্মীয় শিক্ষক থাকতেন না। রোজা মাসে আব্বা বাসায় সূরা তারাবিহ পড়াতেন। ক্লান্ত হয়ে যেতাম। প্রতি দুই রাকাতের শুরুতে বসে থাকতাম একদম রুকুতে যাওয়ার সময় নামাজে যোগ দিতাম। এসব কিছু আব্বা হয়তো দেখতেন না।
বাসায় শেষের দিকে টেলিভিশন ছিল। নামাজের জন্য বা আব্বার উপস্থিতির জন্য কত প্রিয় নাটক দেখতে পারি নাই তার হিসাব নাই। টেলিভিশন দেখবো- এ কথা আব্বাকে অনুরোধ করার মতো সাহসি লোক বাসায় কম ছিলো। আম্মাকে দিয়ে তদবির করিয়ে হয়ত মাঝে মধ্যে কিছু দেখা হয়েছে। তাও ঈদ বা কোনো উপলক্ষ থাকলে। পড়া, নামাজ, সকালে ঘুম থেকে উঠা, সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফেরা, দেরি হলে কৈফিয়ত দেয়া এগুলো ছিল নিয়ম। কোন কিছুর জন্য পালটা যুক্তি দেয়া সংবিধানে ছিল না। শাসনের জন্য হাত তোলা কথা অনেকের পরিবারের ক্ষেত্রে শুনেছি। আমাদের পরিবারে আব্বার কথাই ছিল আইন। এখনো নিজেকে আব্দুন নূর চৌধুরীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি।
গ্রীষ্মের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের ক্লাসগুলোতে শিক্ষকদের সম্মাননা দেয়া হতো। প্রতিটি ক্লাস শিক্ষকরা পরিদর্শন করতেন। ছাত্ররা শিক্ষকদের মাল্য ভূষিত করতো। ক্লাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হতো। ছাত্র ছাত্রীরা বিভিন্ন ধরণের ফলমূলের ছবি অঙ্কন করতো। শিক্ষকেরা মারকিং করতেন। এখনও করেন কিনা জানি না। স্কুল থেকে ফুলের মালা, কাগজের মালা নেয়ার জন্য আমিও মাঝে মধ্যে আব্বার সঙ্গে যেতাম। নামাজ জীবনে বাদ দিয়েছেন দেখি নাই। ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ন। নীতির সঙ্গে আপোস করতেন না। সৎ ও সাহসী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। লেখাপড়া টুকটাক করেছি কিন্তু আব্বার গুণের অনেক কিছুই অর্জন বা আয়ত্ব করতে পারিনি। লিখতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন অনেক কিছুই মনে পড়ছে। আলাহ তায়ালা যেনো তাঁর জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ জায়গা মঞ্জুর করেন এই দোয়া করি। সকলের মা বাবাকে পরম করুনাময় তাঁর আরশের ছায়াতলে স্থান দিবেন- এই মিনতি করছি।
লেখক: সাংবাদিক, আইনজীবী। সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট।