রিভিউতে মুজাহিদের ৩২ যুক্তি !
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ অক্টোবর ২০১৫
ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছেন। আর রিভিউতে তিনি যেসব যুক্তি তুলে ধরবেন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, ৩৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৩২টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যুক্তি হল:
রিভিউ আবেদনের ১ নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে – বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করে। যথা রুস্তম আলী মোল্লা ও জহির উদ্দিন জালাল। ১৯৭১ সালে রুস্তম আলী মোল্লার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং জহির উদ্দিন জালালের বয়স ছিল ১৩ বছর। রুস্তম আলী মোল্লা নিজেকে এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে দাবী করলেও তার সাক্ষ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান। আর জহিরউদ্দিন জালাল একজন শোনা সাক্ষী।
দুই নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে- রুস্তম আলী মোল্লা মুজাহিদকে আর্মি অফিসারের সাথে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করতে দেখেনি। সে দাবী করেছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৩/৪ মাস পর মুজাহিদকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গেটে দেখেছে। সে স্বীকার করেছে যে, মুজাহিদকে পূর্ব থেকে চিনতো না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, পূর্ব থেকে না চেনা স্বত্বেও কিভাবে সে নিজেই কলেজের গেটে মুজাহিদ সাহেবকে চিহ্নিত করল?
তিন নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে- জহির উদ্দিন জালাল তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, নিজামী, মুজাহিদরা ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আসতেন- এই খবরগুলো রুস্তম আলী মোল্লা কেরানীগঞ্জে তাকে জানিয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন রুস্তম আলী মোল্লা তদন্তকালে তার কাছে বলেনি যে, বিচ্ছু জালাল নামে কারো সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। সুতরাং জালালের দাবি অসত্য প্রমানিত।
চার নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে- রুস্তম আলী মোল্লার পিতা মো. রহম আলী মোল্লা ১৯৭১ সালে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের প্রহরী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি আজও জীবিত আছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় তাকে সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি জীবিত থাকা স্বত্বেও অপ্রাপ্ত বয়স্ক একজন ব্যক্তির সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মুজাহিদের মৃত্যুদন্ড কিভাবে বহাল রাখা হয়েছে?
পাঁচ নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে- আলী আহসান মো. মুজাহিদের বিরুদ্ধে আর্মী অফিসারের সাথে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সংঘটনের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার অভিযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কবে কোথায় কোন্ আর্মী অফিসারের সঙ্গে এই ষড়যন্ত্র করেছেন এই মর্মে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি।
ছয় নম্বর যুক্তিতে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১ নম্বর অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে হত্যার কথা উল্লেখ থাকলেও আপিল বিভাগ অত্র অভিযোগ থেকে মুজাহিদকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন।
সাত নম্বর যুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে- মুজাহিদকে আলবদরের কমান্ডার হিসাবে সাজা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কে কখন কোথায় কিভাবে মুজাহিদকে আলবদরের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন? তিনিই কি আলবদরের প্রথম এবং শেষ কমান্ডার? তার আগে এবং পরে কে বা কারা এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন?
রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্যমতে ১৯৭১ সালের মে মাসে জামালপুরে মেজর রিয়াজের প্রচেষ্টায় আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। ঐ সময় মুজাহিদ ঢাকা জেলার ছাত্র সংঘের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তাহলে ঢাকায় বসে কিভাবে তিনি জামালপুরে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হলেন?
এছাড়া রিভিউ আবেদনে মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘দি ভ্যাঙ্কুইশড জেনারেলস’রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে- এই বইয়ে রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল এ এ কে নিয়াজি স্বীকার করেছেন যে, আলবদর বাহিনী সরাসরি আর্মির কমান্ডে এবং কন্ট্রোলে পরিচালিত হতো। প্রশ্ন হলো মুজাহিদ একজন ছাত্রনেতা হয়ে কিভাবে এই বাহিনীর কমান্ডার হলেন? এই বইটি রিভিউ আবেদনের সঙ্গে নতুন দালিলিক সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়েছে।
রিভিউ আবেদনে আরো বলা হয়েছে- জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তার তদন্তকালে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বা শান্তি কমিটির সংশ্লিষ্ট কোন তালিকায় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নাম ছিল মর্মে তিনি কোন প্রমান পাননি। তাহলে আদালত কিসের ভিত্তিতে তাকে আলবদরের কমান্ডার সাব্যস্ত করলেন?
আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ৪২টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর একটিতেও মুজাহিদকে আসামী করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলাগুলোর নথি আদালতে উপস্থাপন করেনি। অথচ ৪২ বছর পর কিভাবে এই হত্যাকান্ডের সব দায়-দায়িত্ব তার ওপর চাপানো হয়েছে?
রিভিউ আবেদনের অপর এক যুক্তিতে দাবি করা হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জহির রায়হানকে আহবায়ক করে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়নি এবং তদন্তকালে তাদের কারো সঙ্গে আলোচনাও করেনি। কেন রাষ্ট্রপক্ষ এই তদন্ত রিপোর্ট জাতির সামনে প্রকাশ করেনি?
রিভিউ আবেদনের সর্বশেষ যুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আপীল বিভাগ সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হত্যার জন্য মুজাহিদকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে পারেননি। আন্দাজ ও অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে নিহত সব বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার জন্য তাকে দায়ী করেছেন।
এদিকে মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, রিভিউ আবেদনে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে আদালত তা সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করলে ফাঁসির দন্ড টিকবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউ শুনানিতে তাদের আইনজীবীরা যেসব যুক্তি তুলে ধরবেন সে বিষয়ে কোন আদেশ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি আপিল বিভাগের রায় পড়ে এটাই বুঝেছি। তবে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার এখতিয়ার আদালতের।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিলেন।ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে মুজাহিদের আইনজীবীরা সর্বোচ্চ আদালতে গেলে সর্বোচ্চ আদালতও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন।
তবে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল তাকে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ শুধুমাত্র ষষ্ঠ অভিযোগে অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদকে ফাঁসির আদেশ দেন। ৩০ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর আজ তিনি এ রায়েল বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে রিভিউ করলেন।